বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলকে তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, "হাসিনা সরকার শুধু গণতন্ত্র নয়, দেশের অর্থনীতি, শাসনব্যবস্থা এবং বিচারব্যবস্থাও পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলেছে।"

নিক্কেই এশিয়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস এই মন্তব্য করেন। সাক্ষাৎকারটি সোমবার প্রকাশিত হয়।

নির্বাচনী সংস্কার ও অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা

ড. ইউনূস জানিয়েছেন, নির্বাচনের আগে দেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়া, সংবিধান এবং বিচারব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। এ লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে একাধিক কমিশন গঠন করেছে। জানুয়ারির মধ্যে এসব কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে পূর্ণাঙ্গ সংস্কার কার্যক্রম শুরু হবে।

তিনি আরও বলেন, “নতুন বাংলাদেশ গড়তে আমরা গোড়া থেকে কাজ করছি। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, জনগণের আস্থা এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ব্যাপক পরিবর্তন প্রয়োজন। নির্বাচনের সময় নির্ভর করবে সংস্কার কাজের অগ্রগতির ওপর।”

তবে, নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য দিয়ে তিনি জানান, “আমি রাজনীতিবিদ নই। আমার কাজ শাসনব্যবস্থায় ন্যায় ও নীতি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা, নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই।”

রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে প্রস্তাব

রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে ড. ইউনূস বলেন, “বাংলাদেশ আর কতদিন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বোঝা বহন করবে? তাদের নিজেদের দেশে ফেরানোর জন্য একটি কার্যকরী সমাধান প্রয়োজন।”

তিনি মিয়ানমারে জাতিসংঘের নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন। মিয়ানমার যদি সম্মত হয়, তাহলে রোহিঙ্গারা সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারবে।

আসিয়ানে সদস্যপদের প্রচেষ্টা

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে আসিয়ানের সদস্যপদ অর্জনকে গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন ড. ইউনূস। তিনি জানান, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে তিনি এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন।

তিনি বলেন, “আমরা প্রথমে সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার হিসেবে স্বীকৃতি পেতে চাই, যা আমাদের পূর্ণ সদস্যপদ অর্জনের পথে প্রথম ধাপ।”

শেখ হাসিনার শাসনের কঠোর সমালোচনা

ড. ইউনূস অভিযোগ করেন, “হাসিনা তার শাসনামলে গণতন্ত্রের মূলনীতি ধ্বংস করেছেন। ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। এর ফলে শাসন কাঠামো সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছে।”

তিনি আরও দাবি করেন, চলতি বছরের আগস্টে ছাত্র-নাগরিকদের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। শেখ হাসিনা পরে ভারতে পালিয়ে যান এবং বর্তমানে তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলার কার্যক্রম চলছে।

সংখ্যালঘু সুরক্ষা ও ভারত প্রসঙ্গ

ভারত সরকারের অভিযোগ যে, শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হয়েছে, তা প্রত্যাখ্যান করেছেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, “এগুলো ভিত্তিহীন প্রোপাগান্ডা। ভারতীয় সাংবাদিকদের আমি আহ্বান জানাই বাংলাদেশে এসে সত্য উদঘাটন করার।”

চীনকে উল্লেখ করলেন ‘বন্ধু’ হিসেবে

ড. ইউনূস চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে ইতিবাচক মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, “চীন আমাদের সমুদ্রবন্দর, সড়ক এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সহায়তা করেছে। এই সম্পর্ক ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।”

সার্ক পুনর্জাগরণের আহ্বান

বাংলাদেশের আঞ্চলিক অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক)-কে পুনরুজ্জীবিত করার আহ্বান জানান ড. ইউনূস। তিনি বলেন, “ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো আমরা আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য ও চলাচলের সুবিধা চাই। এজন্য ভারত ও পাকিস্তানের উত্তেজনা নিরসন প্রয়োজন।”

ড. ইউনূসের এই মন্তব্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং আঞ্চলিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। শেখ হাসিনার শাসন নিয়ে তার কঠোর সমালোচনা এবং আসন্ন নির্বাচনের আগের সংস্কার পরিকল্পনা দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের নজর কেড়েছে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও কূটনীতি কোন পথে এগোবে, তা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।