শেখ হাসিনার জন্য কী করতে ও কতদূর যেতে রাজি ভারত

নিজস্ব প্রতিবেদক: গত বছরের ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় যখন শেখ হাসিনা দিল্লির হিন্ডন বিমানঘাঁটিতে পৌঁছান, ভারতের ধারণা ছিল এটি শুধুমাত্র একটি ‘স্টপওভার’ যাত্রা, যার সময়সীমা ছয়-সাত ঘণ্টার বেশি হবে না। তবে, দিল্লির এই ধারণা খুব দ্রুত ভুল প্রমাণিত হয়। ছয় মাস পার হয়ে এখন সাত মাস হতে চলেছে, কিন্তু তাকে তৃতীয় দেশে পাঠানোর কোনো উদ্যোগ তো দূরের কথা, তিনি এখনো ভারতেই অবস্থান করছেন।

এতদিন পরেও ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে শেখ হাসিনার জন্য কী ব্যবস্থা নেবে, তার কোনো স্পষ্ট সংকেত দেয়নি। যদিও তিনি ভারতের অতিথি হিসেবে অবস্থান করছেন, তবে তিনি এখনো রাজনৈতিক আশ্রয় পাননি।

ভারত তাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার অনুমতি দিলেও, গত মাসে ভারতের অবস্থান আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তারা এক বিবৃতিতে জানায়, শেখ হাসিনার বক্তব্য তার ব্যক্তিগত মতামত এবং এর সাথে ভারতের অবস্থান কোনোভাবেই সম্পর্কিত নয়।

শেখ হাসিনাকে বিচারের জন্য বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর অনুরোধের পরেও ভারত কোনো উত্তর দেয়নি। যদিও শেখ হাসিনা নিজেই তার সমর্থকদের উদ্দেশে দেশে ফেরার কথা বলেছেন, ভারত এ বিষয়ে কোনো সহায়তার ইঙ্গিত দেয়নি।

তাহলে, শেখ হাসিনাকে নিয়ে ভারতের পরিকল্পনা কী? ভারত শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়াতে কতদূর যেতে প্রস্তুত?

জোর করে ফেরত পাঠানো হবে না

ঢাকায় ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী বিশ্বাস করেন, ভারত কখনোই শেখ হাসিনাকে বিপদের মুখে ঠেলে দেবে না। তিনি বলেন, ‘‘শেখ হাসিনা স্পষ্টতই কোথাও যাচ্ছেন না। ভারতে অবস্থান করা তার জন্য নিরাপদ এবং আরামদায়ক।’’

তিনি আরও বলেন, ‘‘ভারত কখনো কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিকে জোর করে ফেরত পাঠানোর নীতি অনুসরণ করেনি। দালাই লামাও তো এখনও ভারতে আছেন। তাই, শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও ভারত তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে, তাকে জোর করে ফেরত পাঠাবে না।’’

শেখ হাসিনাকে বিচারের জন্য ফেরত পাঠানোর অনুরোধের ভবিষ্যত নিয়ে তিনি আশাবাদী নন। তাঁর মতে, যদি এই অনুরোধ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়, তবে ভারত সেটি প্রত্যাখ্যান করতে পারে।

রাজনৈতিক সংলাপ সীমিত

দিল্লিতে শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদের অফিস রয়েছে, যেখানে তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন। তবে মা ও মেয়ের একসাথে থাকার সুযোগ সীমিত, কারণ শেখ হাসিনা ভারতের অতিথি এবং সায়মা জাতিসংঘের প্রতিনিধি।

নয়মী বসু, দিল্লির সিনিয়র কূটনৈতিক সাংবাদিক জানান যে, শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতাদের মাঝে মাঝে সাক্ষাৎ হয়, তবে সেটিও খুব কম। ‘‘নরেন্দ্র মোদি এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল শুধুমাত্র শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন, এবং সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু থাকলে,’’ বলছেন নয়মী বসু।

শেখ হাসিনাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় বক্তৃতা দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হলেও, তাকে স্বাভাবিক সামাজিক মেলামেশা করতে দেওয়া হচ্ছে না। ভারত সরকার তাকে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে, তবে তাকে সীমিত পরিসরে রাখা হচ্ছে।

গোপনীয়তা এবং আনলকিংয়ের সম্ভাবনা

এদিকে, শেখ হাসিনার অবস্থান এখনও গোপন রাখা হয়েছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, তিনি দিল্লির ল্যুটিয়েন্স অঞ্চলের কোনো বাংলোতে অবস্থান করছেন, তবে তার সঠিক অবস্থান কখনোই প্রকাশিত হয়নি।

লন্ডনভিত্তিক লেখক প্রিয়জিৎ দেব সরকার মনে করেন, শেখ হাসিনার গোপনীয়তা ধীরে ধীরে উন্মোচন হতে পারে। ‘‘ভারত শেখ হাসিনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে, তবে ভবিষ্যতে হয়তো তার অবস্থান আরও উন্মুক্ত করা হতে পারে,’’ তিনি বলেন।

আওয়ামী লীগ নেত্রী হিসেবে তার পুনর্বাসন

শেখ হাসিনা যদি বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে আওয়ামী লীগের হাল ধরতে চান, তবে এটি অনেক কঠিন বলে মনে করেন বিশ্লেষক শ্রীরাধা দত্ত। ‘‘ভারত শেখ হাসিনাকে যতদিন চাইবে, ততদিন রাখবে। তবে তার রাজনৈতিক পুনর্বাসন সম্ভব না হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে,’’ তিনি বলেন।

তিনি আরও বলেন, ‘‘শেখ হাসিনার ওপর মানুষের যে ক্ষোভ ও বিতৃষ্ণা, সেটা সহজে ভুলে যাওয়ার মতো নয়। যদিও আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহাসিক দল, তবে তার নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনাকে মেনে নেওয়া নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে।’’

শেখ হাসিনার বর্তমান অবস্থান এবং তার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভারতের ভাবনা এখনও পরিষ্কার হয়নি। তবে এই সময়ে, ভারত তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং রাজনৈতিকভাবে তাকে বিরক্ত না করতে বদ্ধপরিকর।

রনি/