ঢাকা, রবিবার, ৬ জুলাই ২০২৫, ২২ আষাঢ় ১৪৩২

কিডনির দামে স্বপ্ন ভাঙার গল্প, জয়পুরহাটের বৈগুড়ি গ্রাম এখন ‘কিডনি গ্রাম’

জাতীয় ডেস্ক . ২৪ নিউজ
২০২৫ জুলাই ০৬ ১৫:৪৬:০০
কিডনির দামে স্বপ্ন ভাঙার গল্প, জয়পুরহাটের বৈগুড়ি গ্রাম এখন ‘কিডনি গ্রাম’

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশের জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলার বৈগুড়ি—একটি সাধারণ গ্রাম, এখন পরিচিত এক করুণ উপনামে: **‘কিডনি গ্রাম’।** এই নামের পেছনে লুকিয়ে আছে এক ভয়াবহ মানবপাচারের কাহিনি, যা উঠে এসেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে।

এই গ্রামের শফিরউদ্দিন (বয়স ৪৫) জীবনের চরম দারিদ্র্যের মুখে পড়ে ২০২৪ সালে ভারতের একটি দালালচক্রের কাছে নিজের কিডনি বিক্রি করেন। ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার চুক্তি—ভাবেন, সন্তানদের ভালো ভবিষ্যৎ গড়বেন। কিন্তু আজ, সেই স্বপ্ন এক দুঃস্বপ্নে পরিণত। ঘরে অসম্পূর্ণ বাড়ি, হাতে টাকা নেই, আর শরীরে আছে কিডনি অপসারণের পর থেকে চলা অসহ্য যন্ত্রণা।

একই গ্রামের আরও অনেকে শিকার হয়েছেন এই ফাঁদে। ২০১৯ সালে বিধবা জোসনা বেগম ও তার দ্বিতীয় স্বামী মিলে কিডনি বিক্রি করেন কলকাতায়। প্রতিশ্রুতি ছিল ৭ লাখ টাকা, কিন্তু হাতে পান মাত্র ৩ লাখ। আজ তিনি শয্যাশায়ী, দিনরাত কেটে যায় অসহ্য ব্যথায়।

এই দুঃখের তালিকায় আছেন সজল (ছদ্মনাম) নামের এক যুবকও। প্রথমে তিনি কিডনি বিক্রি করেন, পরে নিজেই জড়িয়ে পড়েন দালালি চক্রে। এখন সেই চক্র থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন জীবন রক্ষার তাগিদে।

আলজাজিরার তথ্যে উঠে এসেছে, কালাই উপজেলার গড়ে প্রতি ৩৫ জনের একজন কোনো না কোনোভাবে কিডনি বিক্রির প্রলোভনে পড়েছেন। বেশিরভাগই হতদরিদ্র মানুষ, যাদের অসহায় অবস্থার সুযোগ নিচ্ছে আন্তর্জাতিক পাচার চক্র।

এই চক্র শুধু বাংলাদেশে সীমাবদ্ধ নয়—ভারতের ভেতরে রয়েছে এর বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। জাল নথিপত্র, ভুয়া আত্মীয়তার পরিচয় আর সীমান্তে দুর্বল নজরদারির সুযোগ নিয়ে কোটি কোটি টাকার অবৈধ কিডনি ব্যবসা চালাচ্ছে এই চক্র। প্রশাসন মাঝে মাঝে অভিযান চালালেও, বিশেষজ্ঞদের মতে এই অবৈধ চক্রের মূল গোঁড়াটি এখনও অক্ষত।

অভিযোগ রয়েছে, অপারেশনের পর দালালরা ভুক্তভোগীদের পাসপোর্ট ছিনিয়ে নেয়, যাতে তারা পালাতে না পারে কিংবা আইনগত সাহায্য নিতে না পারে। এই কিডনিগুলো বিক্রি হয় ভারতের অভিজাত ও ধনী ব্যক্তিদের কাছে।

ভারত সরকারের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে সেখানে প্রায় ১৩,৫০০ কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে। অথচ সেবছর প্রায় ২ লাখ মানুষ চূড়ান্ত পর্যায়ের কিডনি ব্যাধিতে আক্রান্ত ছিলেন—যা ইঙ্গিত দেয়, অনেক কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে গোপনে, অবৈধভাবে।

এই ব্যবসায় লাভবান হয় দালাল, অংশ পায় কিছু হাসপাতালও—কিন্তু যারা কিডনি দেয়, তারা চিরদিনের জন্য হয়ে পড়ে প্রতারিত। একদিকে শারীরিক কষ্ট, অন্যদিকে মানসিক অভিশাপ—তারা হারান স্বপ্ন, সম্ভাবনা, এমনকি জীবনের নিরাপত্তা।

বৈগুড়ি আজ শুধু একটি গ্রাম নয়—এটি এখন বাংলাদেশে মানবপাচার আর শোষণের এক নীরব সাক্ষী।

আশা/

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ