ঢাকা, মঙ্গলবার, ১ জুলাই ২০২৫, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২

কে ছিলেন বাংলা ভাই

জাতীয় ডেস্ক . ২৪ নিউজ
২০২৫ জুন ২৯ ০০:০৫:৩২
কে ছিলেন বাংলা ভাই

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশের ইতিহাসে এক সময়ের সবচেয়ে ভয়ংকর ও বিতর্কিত নাম ছিল সিদ্দিকুল ইসলাম, যিনি ‘বাংলা ভাই’ নামে পরিচিত। তার জীবনের শুরু হয়েছিল শিক্ষকতা দিয়ে, কিন্তু শেষটা হয়েছিল রাষ্ট্রবিরোধী জঙ্গিবাদ, সশস্ত্র সহিংসতা ও মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে।

জেএমবির উত্থান

১৯৯৮ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকার পালমপুরে শায়খ আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে ‘জামাআতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ’ (জেএমবি) প্রতিষ্ঠিত হয়। সংগঠনের প্রাথমিক কাজ ছিল দাওয়াত, লিফলেট বিতরণ এবং সাংগঠনিক বিস্তার। তারা ছয়টি অঞ্চলে কার্যক্রম শুরু করে।

২০০০ সালে বান্দরবানে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) একটি ক্যাম্পে জেএমবি সদস্যদের প্রথম সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ২০০১ সালে সাতক্ষীরার একটি সিনেমা হলে বোমা হামলার মধ্য দিয়ে তাদের সহিংস কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর ময়মনসিংহ, নাটোরসহ বিভিন্ন স্থানে হামলা চালানো হয়।

বাংলা ভাইয়ের উত্থান

২০০৪ সালে বাংলা ভাই রাজশাহী ও নওগাঁ অঞ্চলে পরিচিতি পান। তিনি ‘জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ’ (জেএমজেবি) নামের একটি গোষ্ঠীর নেতা হিসেবে স্থানীয় অপরাধ দমনের নামে অভিযান শুরু করেন। কিছু পুলিশ সদস্য ও প্রশাসনের মৌন সমর্থনে ওই অভিযানে বিচারবহির্ভূত সহিংসতা চালানো হয়।

তার নেতৃত্বে মাত্র তিন মাসে ২৩ জনকে হত্যা করা হয় এবং বহু নিরীহ মানুষ নির্যাতনের শিকার হন।

ব্যক্তিগত পরিচয়

বাংলা ভাই ১৯৭০ সালে রাজশাহীর বাগমারায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পারিবারিক শিকড় ছিল বগুড়ার গাবতলী উপজেলার কর্ণপাড়া গ্রামে। বাবা নাজির হোসেন প্রামাণিকের পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়।

তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ঢাকার দুটি কোচিং সেন্টারে বাংলা পড়াতেন বলে শিক্ষার্থীরা তাকে ‘বাংলা ভাই’ নামে ডাকত। তবে একটি ভিন্ন দাবিও রয়েছে—অনেকে বলেন, মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি আফগানিস্তানে যান এবং ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়।

শিক্ষা ও রাজনীতি

শিক্ষাজীবনে তিনি বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। ছাত্রজীবনের শুরুতে ছাত্রলীগের সমর্থক থাকলেও পরে ইসলামী ছাত্রশিবিরে যোগ দেন। ১৯৯৫ সালে জামায়াত ইসলাম নারীদের নেতৃত্ব মেনে নেওয়ায় তিনি শিবির ছেড়ে দেন এবং পরে জেএমজেবির সঙ্গে যুক্ত হন।

জেএমবিতে ভূমিকা

শায়খ আব্দুর রহমানের নজরে এসে বাংলা ভাই জেএমবির ‘অপারেশনাল চিফ’ হিসেবে দায়িত্ব পান। অভিযোগ রয়েছে, বিদেশি সহায়তার অর্থ তিনি মসজিদ-মাদ্রাসার আড়ালে অস্ত্র প্রশিক্ষণ ক্যাম্প পরিচালনায় ব্যবহার করতেন। দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় এসব ক্যাম্প চালু হয়।

ভয়াবহ হামলার নেতৃত্ব

২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট বাংলাদেশের ৬৩টি জেলায় একযোগে ৪৫৯টি স্থানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এতে ২ জন নিহত ও ২০০ জন আহত হন। একই বছরের শেষ দিকে আত্মঘাতী বোমা হামলায় দেশজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এসব হামলার পেছনে জেএমবির নেতৃত্বে বাংলা ভাইয়ের সম্পৃক্ততা ছিল বলে অভিযোগ ওঠে।

গ্রেপ্তার, বিচার ও ফাঁসি

২০০৬ সালের ৬ মার্চ ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে বাংলা ভাইকে র‍্যাব গ্রেফতার করে। ২০০৫ সালের ঝালকাঠিতে বিচারক হত্যার মামলায় তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

২০০৭ সালের ২৯ মার্চ মধ্যরাতে বাংলা ভাইসহ জেএমবির শীর্ষ ৬ নেতার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এর মধ্য দিয়ে দেশের ইতিহাসে জঙ্গিবাদের এক রক্তাক্ত অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে।

সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল একজন শিক্ষক হিসেবে, কিন্তু শেষ হয়েছিল জঙ্গিবাদের ভয়াল ছায়ায়। এক সময় তাকে দেখা হতো অপরাধ দমনের ‘নায়ক’ হিসেবে, পরে তিনি হয়ে ওঠেন সহিংস উগ্রবাদের প্রতীক। ইতিহাসের পাতা আজ তাকে স্মরণ করে এক ভয়ঙ্কর নাম হিসেবে।

সোহাগ/

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ