ঢাকা, বুধবার, ৯ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২

কক্ষপথে রাশিয়ার অস্ত্রবাহী স্যাটেলাইট: কী জানা যাচ্ছে

বিশ্ব ডেস্ক . ২৪ নিউজ
২০২৫ জুলাই ০৯ ০৮:৪৫:১৮
কক্ষপথে রাশিয়ার অস্ত্রবাহী স্যাটেলাইট: কী জানা যাচ্ছে

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাশিয়ার নতুন ‘মাতৃস্যাটেলাইট’ কর্মসূচি ঘিরে আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ বাড়ছে। এক সময়ের গবেষণা ও যোগাযোগের ক্ষেত্র মহাকাশ এখন রূপ নিচ্ছে আধুনিক সামরিক প্রতিযোগিতার মঞ্চে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো মনে করছে, রাশিয়ার এই মহাকাশভিত্তিক কৌশল তাদের জন্য একটি বড় হুমকি।

রুশ লোককথার বিখ্যাত পুতুল ‘মাত্রিওশকা’র মতো বহুস্তরবিশিষ্ট এই স্যাটেলাইটগুলোকে বলা হচ্ছে ‘মাতৃস্যাটেলাইট’। কক্ষপথে পৌঁছে এরা সময় ও লক্ষ্য অনুযায়ী ছোট ছোট সাবস্যাটেলাইট বা গোপন বস্তু ছেড়ে দেয়। এসব বস্তু নজরদারি ছাড়াও প্রয়োজনে হামলা চালানোর মতো ক্ষমতা রাখে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব সাবস্যাটেলাইটের কিছুতে অ্যান্টি-স্যাটেলাইট (ASAT) অস্ত্র থাকতে পারে, যা প্রতিপক্ষের স্যাটেলাইটকে নিঃশব্দে অকার্যকর করে দিতে পারে।

২০২২ সালে মার্কিন গুপ্তচর স্যাটেলাইট UASA-326 উৎক্ষেপণ করা হয় স্পেসএক্সের ফ্যালকন-৯ রকেটে। এটি KH-11 সিরিজের একটি উন্নত সংস্করণ বলে ধারণা করা হয়, যার মাধ্যমে রিয়েল-টাইম হাই-রেজুলুশনের ছবি পাঠানো সম্ভব।

এই স্যাটেলাইটটির আশেপাশেই ঘুরছিল রাশিয়ার কসমস-২৫৫৮। তিন বছর চুপচাপ থেকে অবশেষে ২০২৫ সালের ২৮ জুন এটি ‘অবজেক্ট–সি’ নামে একটি রহস্যজনক বস্তু কক্ষপথে ছেড়ে দেয়। ধারণা করা হচ্ছে, এটি একটি আক্রমণাত্মক সাবস্যাটেলাইট।

বিশ্লেষকরা এই ধরনের কর্মকাণ্ডকে বলছেন ‘স্পেস স্টকিং’। এসব স্যাটেলাইটকে বলা হচ্ছে ‘মহাকাশের গুপ্ত ঘাতক’। কারণ এগুলোর গতিবিধি চুপচাপ, উদ্দেশ্য অস্পষ্ট এবং আচরণ সন্দেহজনক।

এই ‘মাতৃস্যাটেলাইট’ প্রকল্প নতুন নয়। এটি ২০১১ সালে শুরু হওয়া গোপন সামরিক উদ্যোগ ‘প্রজেক্ট নিভেলি’র অংশ। গবেষক মার্কো ল্যাংব্রুক এবং বিশ্লেষক বার্ট হেনড্রিক্স জানাচ্ছেন, রাশিয়া এ ধরনের অস্ত্রবাহী স্যাটেলাইট অন্তত তিনবার পাঠিয়েছে এবং সেগুলো কখনো নিজের কৃত্রিম উপগ্রহে হামলার অনুশীলন, কখনো কক্ষপথ বদল, কখনোবা গোপন প্রজেক্টাইল নিক্ষেপের মাধ্যমে সামরিক মহড়া চালিয়েছে।

২০১৩ ও ২০১৫ সালে কসমস-২৪৯১ ও ২৪৯৯ রহস্যজনকভাবে ভেঙে পড়ে। ধারণা করা হয়, এটি ছিল মহাকাশে রুশ অস্ত্র পরীক্ষার অংশ। ২০১৭ সালে কসমস-২৫১৯ থেকে আলাদা হয় কসমস-২৫২১, যার মধ্য থেকে বের হয় আরেকটি স্যাটেলাইট কসমস-২৫২৩। এটি আচমকা কক্ষপথ পরিবর্তন করে সবাইকে বিস্মিত করে। ২০২০ সালে কসমস-২৫৪৩ ছুড়ে দেয় এক গোপন বস্তু, যার নাম ছিল কসমস-২৫৩৫—যার কোনো আন্তর্জাতিক নিবন্ধনও ছিল না।

এই প্রকল্প পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে মস্কোভিত্তিক প্রতিষ্ঠান TsNIIKhM, যারা ২০১১ সালে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। স্যাটেলাইট নির্মাণে কাজ করছে NPO Lavochkin এবং গোপন অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্রধর্মী পে-লোড তৈরি করছে TsNIIKhM।

২০২৪ সালের এপ্রিলে ন্যাটোর মহাসচিব মার্ক রুটে সতর্ক করেন যে, রাশিয়া হয়তো মহাকাশে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার মতে, এ ধরনের পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করবে এবং বিশ্বব্যাপী স্যাটেলাইটনির্ভর যোগাযোগ ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য ভয়ানক হুমকি তৈরি করবে।

তিনি জানান, স্যাটেলাইটে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটলে পৃথিবীর ন্যাভিগেশন, সামরিক গোয়েন্দা ও যোগাযোগব্যবস্থা একযোগে অচল হয়ে যেতে পারে।

রাশিয়ার ‘মাতৃস্যাটেলাইট’ কৌশল শুধুমাত্র নজরদারিতে সীমাবদ্ধ নয়। এটি মহাকাশকে পরিণত করছে একটি সম্ভাব্য যুদ্ধক্ষেত্রে—যেখানে গোলাগুলি বা বিস্ফোরণ হবে না, কিন্তু সংঘর্ষ হবে নিঃশব্দে, অদৃশ্য অস্ত্রে, কক্ষপথ পরিবর্তনে বা স্যাটেলাইট নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে।

যতই বিশ্ব স্যাটেলাইটনির্ভর হয়ে উঠছে, ততই এই ছায়াযুদ্ধ বাস্তব হয়ে ওঠার ঝুঁকি বাড়ছে। রাশিয়ার নিভেলি প্রকল্প সেই যুদ্ধকে একধাপ এগিয়ে নিচ্ছে—নীরব, গোপন, অথচ ভয়ংকর এক ভবিষ্যতের দিকে।

সিদ্দিকা/

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ